May 20, 2025

Daily Amar Vasha

উত্তর জনপদে সত্য প্রকাশে দৃঢ়

ধর্ষণ প্রতিরোধে সামাজিক দায়বদ্ধতা

সম্পাদকীয়ঃ

একজন ধর্ষক ঠিক কী কারণে ধর্ষণ করে এটার ব্যাখ্যা বিভিন্নভাবে দেওয়া হয়। যেমন মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এটি ধর্ষকের যৌনসুখ পাওয়ার তাৎক্ষণিক একটি চেষ্টা, ধর্ষক একজন মানসিক রোগী, একজন অসুস্থ পাগল তারা ভালো-মন্দ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়। আবার কিছু মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, কিছু ধর্ষক আর্থসামাজিকভাবে এমন, জৈবিক যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য তাদের কাছে কোনো বৈধ উপায় নেই, তাই তারা ধর্ষণের পথই বেছে নেয়, আবার কিছু ধর্ষক আছে, যারা সুযোগসন্ধানী, তারা আধুনিক, প্রগতিশীল নারীর সংস্পর্শে আসতে ও মিশতে চায় আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের। তবে তার প্রত্যাশামতো যদি এই নারীরা সম্মতি না দেয়, তাহলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ধর্ষণে লিপ্ত হয়। আবার কিছু ধর্ষক আছে, যারা মোহনীয় ক্ষমতার অধিকারী। তারা এক প্রকার পেশাদার ধর্ষক, তারা বহুবার বহু নারীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে আগে. মেয়েদের তারা বোকা বানাতে ওস্তাদ। তবে কোনো কারণে যদি মেয়েরা তাদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে রাজি না হয়, তারা বলপ্রয়োগ করে এবং ধর্ষণ করে।

অন্যদিকে, সমাজবিজ্ঞানও কিন্তু সামাজিক প্রপঞ্চের আলোকে ধর্ষণকে ব্যাখ্যা করেছে। যেমন তারা বলেছে, পুরুষতান্ত্রিকতা এবং পৌরুষত্বের ক্ষমতা জাহির করার একটা উপায় হচ্ছে ধর্ষণ। নারীবাদী রাসেল বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী-পুরুষের অসম অবস্থান এবং সমাজ কর্তৃক পুরুষকে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা প্রদান তাদের ধর্ষক হতে প্ররোচিত করে। আবার কিছু কনজারভেটিভ ধারার তাত্ত্বিক, পর্নোগ্রাফির বহুল ব্যবহার ধর্ষণের কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও তাদের এই বক্তব্য অনেক তাত্ত্বিকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। আবার সমাজ-সংস্কৃতি যদি ধর্ষকদের জন্য সহায়ক হয়, তাহলেও ধর্ষণ বাড়তে পারে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা অভিমত দিয়েছেন। যদি সমাজ এমন হয়, ধর্ষক তার ক্ষমতা ব্যবহার করে ক্ষমতাহীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলেও ধর্ষণ বাড়বে বৈ কমবে না। সামাজিক কিংবা মনোবৈজ্ঞানিক, কোনো তত্ত্বই শতভাগ নির্ভুল বা সমালোচনামুক্ত নয়। ধর্ষণের কেসগুলো বিবেচনা করলে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একই সঙ্গে একের অধিক ঘটনা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের প্রতিটি বক্তব্যই যেন আমাদের সমাজের আজকের চিত্রকে তুলে ধরছে। সামাজিক, মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব থেকে সমন্বয়ের মাধ্যমে নারীদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন ইউএন ওমেন তাদের প্রকাশিত রিপোর্টে বলেছে, আমরা যেভাবেই ধর্ষণকে ব্যাখ্যা করি না কেন, তবু এটাই বাস্তব যে পুরুষতান্ত্রিকতা, ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণ থেকেই ধর্ষকের জন্ম।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ধর্ষণের ঘটনা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। সচেতনতার অভাবে, লোকলজ্জা এবং সামাজিক ভয়ভীতির কারণে এবং কম মিডিয়া কাভারেজ পাওয়ার কারণে ধর্ষণের ঘটনা কম রিপোর্ট হতো, যা আপাতদৃষ্টিতে নিয়ন্ত্রিত সংখ্যাকেই তুলে ধরে। সেই সঙ্গে অনস্বীকার্য, তখন মানুষ সামাজিক মূল্যবোধ, সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষা, ধর্মীয় আচার-আচরণ নিজেদের মধ্যে বেশি ধারণ করত, যা ধর্ষণের মতো গর্হিত অপরাধকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। সামাজিক মূল্যবোধের স্খলনের ফলে মানুষ এখন বোধ-বিবেচনাহীন হয়ে কোমলমতি শিশু থেকে শুরু করে বয়স্কা-বৃদ্ধাকেও রেহাই দিচ্ছে না। এই যখন আমাদের চিন্তাধারা, সেখানে আইন করে, শাস্তি দিয়ে আসলে কতটুকু ধর্ষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব, তা সত্যিই বিবেচনার বিষয়। বরং একজন মানুষ যেন ধর্ষকে পরিণত হতে না পারে সেই চেষ্টা করা উচিত। কারণ মায়ের গর্ভ থেকে সে ধর্ষক হয়ে জন্মায়নি। ধর্ষক যখন জানে ধর্ষণের অপরাধে তাকে তার পরিবারের কাছে জবাবদিহি করতে হবে না, তার পরিবার তাকে শাস্তি দেবে না, কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন সে নারী বন্ধুকে সম্মান কীভাবে করতে হয় সেটা না শিখে, বরং সে দেখেছে তার শিক্ষক ধর্ষণের অভিযোগ নিয়েও দিব্যি চাকরি করছে, সমাজে সম্মান পাচ্ছে কিংবা তার রাজনীতি করা বন্ধুটি একের পর এক ধর্ষণের গল্প মজা করে সবাইকে জানানোর পরও রাজনীতির পদ-পদবি তাকে দেওয়া হচ্ছে। কেবল রাষ্ট্র নয়, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বন্ধু-বান্ধব, মিডিয়াসহ ধর্ষণ প্রতিরোধে সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নতুবা ধর্ষণের এই মহোৎসব চলতে থাকলে মেয়েদের শিক্ষালাভ, বাইরে চলাচল কিংবা কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। এতে জয়ী হবে হয়তো পুরুষতন্ত্র, কিন্তু পরাজিত হবে রাষ্ট্রের উন্নয়ন কার্যক্রম।

“সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত”

 

Viewed 870 times

Spread the news
Copyright © All rights reserved. | Newsphere by AF themes.
error: Content is protected !!