May 20, 2025

Daily Amar Vasha

উত্তর জনপদে সত্য প্রকাশে দৃঢ়

নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য দুটোরই ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

সম্পাদকীয়ঃ 

খাদ্য মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে একটি। এটি জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য উপাদানও বটে। যে কারণে খাদ্যনিরাপত্তা অপরিহার্য। কিন্তু দেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে এবং কৃষিজমির পরিমাণ কমছে, তাতে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক। বিভিন্ন পরিসংখ্যানেও দেখা যাচ্ছে প্রতি বছরই কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্যে দেখা গেছে, সর্বশেষ পাঁচ বছরে আবাদকৃত জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ২ শতাংশ। এর বিপরীতে পাঁচ বছরে হেক্টরপ্রতি ফলন বেড়েছে কেবল ৪ শতাংশ। আর চাল উৎপাদন মাত্র ২ শতাংশ বেড়েছে। আবার কৃষিশুমারির তথ্যের ভিত্তিতে দেশের কৃষিজমির বিভিন্ন রূপান্তর ও জনপ্রতি এর পরিমাণসংক্রান্ত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৪ থেকে ২০১৯ সাল ৩৫ বছরে গড়ে কৃষিজমির পরিমাণ কমেছে প্রায় দশমিক ৩৫ শতাংশ হারে।

 

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আবাস ও ব্যবসাকেন্দ্রিক নতুন নতুন কার্যক্রমের পরিসর বেড়েছে। কোথাও আবার সরকারিভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়েছে এবং বাস্তবায়ন হয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প। অর্থাৎ সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রেও কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া দুই-তিন ফসলি জমিও নানাভাবে অকৃষিকাজে ব্যবহার হচ্ছে। অথচ আইনে কৃষিজমিকে অন্য কাজে ব্যবহারের সুযোগ নেই। এর অর্থ, অনেক ক্ষেত্রেই কৃষিজমি রক্ষা আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এসব করা হয়েছে।

কৃষিজমি হ্রাসসহ উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের অভাব, কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং সে অনুপাতে কৃষক আয় করতে না পারাসহ নানা কারণ কৃষি উৎপাদনে প্রভাব পড়ছে। সব মিলিয়ে গত কয়েক বছর দেশের কৃষি খাত এক ধরনের অচলায়তনে রূপ নিয়েছে। খাতসংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করা না গেলে খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলে বড় ধরনের অভিঘাত এসে পড়বে।

 

খাদ্যনিরাপত্তার পাশাপাশি বর্তমানে আরেকটি উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে ভেজাল খাদ্য, যা সুস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বিশ্বে প্রতি বছর খাদ্যবাহিত রোগে ৪ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ভেজাল খাদ্য। উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানো পর্যন্ত খাদ্যে বিষাক্ত ভারী ধাতু যুক্ত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইমপ্যাক্টের বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা সূচক ২০২২ অনুযায়ী, গুণমান ও নিরাপদ বিবেচনায় বিশ্বের ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম। এ সূচকে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের অবস্থান ৬৫তম এবং ভারতের অবস্থান ৬৭তম। অর্থাৎ বাংলাদেশের খাদ্য প্রতিবেশী দেশের খাদ্যের তুলনায় অনেক বেশি অনিরাপদ। সম্প্রতি খাদ্যনিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য—দুটোরই ঝুঁকিতে থাকার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে বণিক বার্তা আয়োজিত ‘কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাণ-প্রকৃতি সম্মেলনের’ আলোচনায়ও উঠে এসেছে। সেখানে আলোচকরা খাদ্যনিরাপত্তাহীনতাকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে জরুরি হলো খাদ্যনিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্যে জোর দেয়া। নয়তো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে দেশের জনগণ। সে বিপর্যয় এড়াতে হলে কৃষি ও কৃষকের স্বার্থরক্ষায় মনোনিবেশ করা জরুরি। কৃষকদেরও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, পরিবেশ, মাটি, পানি, বাতাসের কোনো ক্ষতি না করে ফসল উৎপাদন করা ছাড়া নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা কঠিন হবে। সেক্ষেত্রে সরকারের নীতি—কৌশল গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের দিকেও নজর দিতে হবে।

এক্ষেত্রে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিতে হবে কৃষিজমি রক্ষায়। ওই সম্মেলনে পরিবেশ উপদেষ্টা দুই-তিন মাসের মধ্যে কৃষিজমি সুরক্ষা আইন পাস হতে পারে বলে জানিয়েছেন। সবার প্রত্যাশা, আইনটি পাস এবং এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন হোক। কৃষিজমি বাঁচানো গেলে কৃষি উৎপাদন হ্রাসের প্রবণতা কমে আসবে। কৃষিজমি রক্ষার পাশাপাশি জমির পুষ্টিগুণ ধরে রাখাও আবশ্যক, যা নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত।

 

অতিরিক্ত রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি সম্ভব ঠিকই, তবে তা কখনই স্বাস্থ্যসম্মত হবে না। কীটনাশক অবশ্যই পরিমিত মাত্রায় হতে হবে। আবার অনেক জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে তা চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এর অন্যতম কারণ অতিরিক্ত লবণ পানি ও অপরিকল্পিতভাবে মাছের ঘের নির্মাণ। এতেও কৃষক ও কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার বন্ধের পাশাপাশি লবণ পানি থেকেও কৃষিজমির সুরক্ষা নিশ্চিত করা আবশ্যক।

 

এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দেশে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। বায়ু, পানি দূষণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে মাটি দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একদিকে আবাদি জমির পরিমাণ কমে আসছে, অন্যদিকে কমছে আবাদি জমির মাটির পুষ্টিগুণ। সরকারি এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট ভূমির প্রায় ৭৫ শতাংশই এখন উর্বরতা ঘাটতিতে ভুগছে। ফসফরাস, নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম, সালফার, বোরন, জিংক মাটির গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। মৃত্তিকাসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) ‘সয়েল ফার্টিলিটি ট্রেন্ডস ইন বাংলাদেশ ২০১০ টু ২০২০’ শীর্ষক গবেষণা বলছে, এক দশকের ব্যবধানে দেশের আবাদি জমিতে গুরুত্বপূর্ণ এসব পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাবারের পুষ্টিগুণ নিশ্চিতে পরিবেশ দূষণ কমানো তাই অতীব জরুরি।

কৃষিজমির সঙ্গে কৃষকের সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য কৃষক যেন উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পান তা নিশ্চিত করা জরুরি। ফসলের দাম যেন পড়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দেয়া জরুরি। হিমাগারে পণ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় সুবিধাও নিশ্চিত করেতে হবে। এ বছর হিমাগারের ভাড়া বৃদ্ধিসংক্রান্ত কারণে কৃষদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় সড়কে আলু ফেলে আন্দোলন করেছেন তারা। এ ধরনের ভোগান্তি কাম্য নয়। অভ্যন্তরীণ চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদন হলে তা রফতানির ব্যবস্থা সরকারের নেয়া উচিত। কিংবা সরকারিভাবে মজুদ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষককে বাঁচাতে হলে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের বিকল্প নেই। আবার অনেক সময় মানসম্মত বীজের অভাবে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ফসল উৎপাদন ব্যাহত হতে দেখা যায়। এতে কৃষকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, একইভাবে সরবরাহেও ঘাটতি তৈরি হয়, যা দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ায়। সুতরাং কৃষকের সুরক্ষায় মানসম্মত বীজের সরবরাহ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা দিয়ে কৃষিকাজের উৎসাহ বজায় রাখতে হবে। সর্বোপরি সরকারের এমন নীতি—কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন, যা জনগণের খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখবে।

Viewed 3800 times

Spread the news
Copyright © All rights reserved. | Newsphere by AF themes.
error: Content is protected !!