সাংবাদিকরা নির্যাতিত হচ্ছে কেন?

সম্পাদকীয়ঃ
দেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি এবার নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন জাতির বিবেক বলে পরিচিত সাংবাদিক সমাজ। যা কোনো সভ্য দেশের মানুষ আশা করে না। বিগত দিনে দেশে যে সমস্ত সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের কোনো সঠিক বিচার না হওয়ার কারণে দেশে সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। অপরাধীরা একজোট হয়ে সাংবাদিকদের উপর চড়াও হচ্ছে। অপরাধী চক্রের মতো যেন পিছিয়ে নেই আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীও। নির্যাতনকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্ব যাদের হাতে সেই পুলিশই এখন একের পর এক সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রতি দেশের পুলিশকে জনবান্ধব হওয়ার জন্য বললেও সেখানে হচ্ছে তার উল্টো। যে দেশে জাতির বিবেক সাংবাদিক সমাজ পুলিশের নির্যাতনের শিকার হতে হয় সে দেশে সাধারণ মানুষের অবস্থা কি তা দেশের মানুষ জানতে চায়। জানা যায়, সংবাদ প্রকাশের জেরে সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাভার প্রতিনিধি নাজমুল হুদাকে একাধিক মামলা দিয়ে জেলে পাঠায় পুলিশ। এমনকি তাকে শারীরিকভাবেও নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠে। সর্বশেষ ২৬ জানুয়ারি রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে তেল-গ্যাস ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির হরতালের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন বেসরকারি টিভি চ্যানেল এটিএন নিউজের রিপোর্টার ও ক্যামেরাপারসন। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিগত ২০১৬ সালে ১১৭ জন সাংবাদিক নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
সাংবাদিক হত্যার বিচার এবং হয়রানি-নির্যাতনের ঘটনার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ না হওয়ায় এসব ঘটনা বেড়ে গেছে। দ্বিধাবিভক্তি দূর করে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে না পারলে এসব ঘটনা প্রতিরোধ করা যাবে না। সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের পাশাপাশি একটি কার্যকর সুরক্ষা কৌশল ও নীতিমালাও জরুরি বলে মনে করেন দেশের বিজ্ঞমহল। বিচারহীনতার কারণে সাংবাদিকদের উপর পুলিশ, সন্ত্রাসী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা নির্যাতন এবং হয়রানি করছে। হত্যাকা-সহ সাংবাদিকদের উপর নির্যাতনের ঘটনার সঠিক বিচার হলে এসব ঘটনা মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছাত না।
দায়িত্বপালনকালে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের নির্যাতনে পুলিশের ভেতর পেশাদারিত্বের অভাব দেখা দিয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অপরাধের কথা তুলে ধরায় এখন সাংবাদিকদের নির্যাতন করছে। মিথ্যা মামলায় হয়রানি করছে। আসকের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৬ সালে ১১৭ সাংবাদিক হামলা, হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতিতদের মধ্যে সন্ত্রাসী হামলা-হুমকির শিকার ৩৭ জন, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন ২১, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নির্যাতিত ৯ এবং মামলার শিকার হয়েছেন ২০ জন। এদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধের খবর প্রকাশ করায় সাংবাদিকদের হামলা-মামলা দিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতা ও অপরাধীদের পাশাপাশি পুলিশের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের নির্যাতন ও হয়রানি করা হচ্ছে। সাংবাদিক সংগঠনগুলো ও সাংবাদিক নেতাদের পক্ষ থেকে এসব ঘটনার জোরালো কোনো প্রতিবাদ ও পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় দিনদিন নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা বাড়ছে। অনেক সময় সাংবাদিক নেতারাও এসব ঘটনার বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিবাদ করছেন না। প্রতিবাদ করলে ভিন্নমতের সাংবাদিক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবেন এ আশঙ্কায় অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিক নেতারাও গণমাধ্যমে মন্তব্য করতেও বিব্রতবোধ করছেন।
দেশের সকল সাংবাদিকদের রাজনৈতিক দলীয় অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে নিজেদের রক্ষা করতে। কারণ দলীয় অবস্থানে থেকে কখনো সকল সাংবাদিকের স্বার্থ রক্ষা করা যাবে না। সাংবাদিকদের রাজনীতি করতে বাঁধা নেই। তবে দায়িত্ব পালনকালে মহান পেশার কথা মনে রেখে দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করতে হবে। দেশের সকল মানুষের মধ্যে দলীয় আদর্শ থাকতে পারে কিন্তু সেটা যদি দলীয় আনুগত্যে পরিণত হয় তাহলে অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব হবে না। আর ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের মাত্রাও কমবে না। তাই নিজেদের কথা চিন্তা করে দেশের সকল সাংবাদিক একত্র হয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে একদিকে যেমন নির্যাতনের ঘটনা কমবে, তেমনি সাংবাদিকদের কর্মপরিবেশও ফিরে আসবে।
Viewed 860 times