ধর্ষণ—সমাজের বিবেকের পরাজয়
সম্পাদকীয়ঃ ধর্ষণ আজ শুধু একটি অপরাধ নয়, এটি আমাদের সমাজের নৈতিক ও মানবিক কাঠামোর ভয়াবহ ভাঙনের প্রতিচ্ছবি। একবিংশ শতাব্দীতেও যখন নারী ও শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, তখন বুঝতে কষ্ট হয় আমরা কোন সভ্যতার কথা বলি। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় ধর্ষণের সংবাদ—কোথাও স্কুলছাত্রী, কোথাও গৃহবধূ, কোথাও আবার প্রতিবন্ধী নারী। এই অমানবিক ঘটনা সমাজে এক গভীর সামজিক অবক্ষয়ের প্রমাণ বহন করছে।
ধর্ষণ কেবল শারীরিক নির্যাতন নয়, এটি এক নারীর মানসিক ও আত্মিক সত্তার চূড়ান্ত লাঞ্ছনা। অথচ আমাদের সমাজে এখনো অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার নারীকে দোষারোপ করা হয়। পরিবার ও সমাজের চাপের মুখে অনেক ভুক্তভোগী নীরব থাকতে বাধ্য হন। এই নীরবতা অপরাধীদের সাহস জোগায়, আর সমাজের নৈতিক অবক্ষয়কে আরও গভীর করে তোলে।
অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে অনেক সময় ধর্ষণ মামলায় ভিকটিমকে জিম্মি করে ফেলা হয়। সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অবস্থানকে ঢাল বানিয়ে অপরাধ ঢেকে ফেলতে চেষ্টা করেন। একদিকে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল, অন্যদিকে হুমকি, প্রলোভন ও সামাজিক অপমানের ভয়ে ভুক্তভোগী পরিবার ন্যায়বিচার থেকে সরে দাঁড়ায়। ফলে অপরাধীরা থেকে যায় অদণ্ডিত, আর সমাজে গড়ে ওঠে ‘অপরাধ করেও পার পাওয়া’র সংস্কৃতি।
এক্ষেত্রে প্রশাসনিক গাফিলতিও একটি বড় কারণ। অনেক সময় পুলিশ ধর্ষণের মামলা নিতে গড়িমসি করে, তদন্তে অবহেলা দেখা যায়, প্রমাণ নষ্ট হয়। কোথাও কোথাও প্রভাবশালীদের চাপে তদন্ত প্রভাবিত হয়। এমনকি আদালতে মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকে, যা ভুক্তভোগীর মানসিক যন্ত্রণাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি ধর্ষকদের উৎসাহিত করে—কারণ তারা জানে, শাস্তি প্রায় অসম্ভব।
ধর্ষণ প্রতিরোধে শুধু আইন কঠোর করলেই হবে না, প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা ও মানসিকতার পরিবর্তন। পরিবার থেকেই সন্তানদের শেখাতে হবে নারীকে সম্মান করা, সমান অধিকার ও মর্যাদা দেওয়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি জরুরি। ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদেরও এগিয়ে আসতে হবে, কারণ তাদের কথাই সাধারণ মানুষ বেশি শোনে।
গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। অনেক সময় ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ বা ঘটনাকে উত্তেজনাপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হয়, যা পুনরায় মানসিক নির্যাতনের জন্ম দেয়। অপরাধীকে প্রকাশ করা জরুরি, কিন্তু ভুক্তভোগীর মর্যাদা রক্ষা করা আরও জরুরি।
সবশেষে বলা যায়, ধর্ষণ শুধু একজন নারীর নয়—একটি জাতির সম্মানের উপর আঘাত। যখন আমরা কোনো ধর্ষণের ঘটনায় নীরব থাকি, তখন আমরা নিজের অজান্তেই অপরাধীদের পক্ষে দাঁড়াই। রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সমাজ—সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। ধর্ষণের বিচার হতে হবে দ্রুত ও দৃশ্যমানভাবে, যাতে অপরাধীরা জানে, কোনো শক্তিই ন্যায়বিচারকে রুখতে পারবে না।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিটি মানুষের অবস্থানই হোক দৃঢ়, সচেতন ও প্রতিবাদী—তবেই আমরা গড়ে তুলতে পারবো এমন এক সমাজ, যেখানে নারী হবে নিরাপদ, সম্মানিত ও স্বাধীন। এটাই হোক মানবতার আসল বিজয়।
Viewed 3750 times