July 4, 2025

Daily Amar Vasha

উত্তর জনপদে সত্য প্রকাশে দৃঢ়

বিবাহ বিচ্ছেদ ও সমাজ ভাবনা

সম্পাদকীয়ঃ

বিয়ের বন্ধন একটি পবিত্র বন্ধন। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান যে ধর্মেরই হোক না কেন, বিয়ের যে মূলমন্ত্র তা হলো একজন ছেলে বা একজন মেয়ের একসঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি। সামাজিকভাবে এই প্রতিশ্রুতিকে বৈধ করা হয়। এই বৈধতা বা পারস্পরিক প্রতিশ্রুতির আরেক নাম বিয়ে বা বিবাহবন্ধন। পারিবারিক জীবনযাপন শুরু হয়ে থাকে বিয়ের মাধ্যমে। এজন্য বিয়ের আগের ও পরের দৈনন্দিন জীবনে অনেক পরিবর্তন চলে আসে। বিয়ে হয়ে গেলেই যেসব দায়দায়িত্ব শেষ ব্যাপারটা কিন্তু তেমন নয়। দায়িত্বটা বরং বেড়েই যায়। শুধু আবেগ নয়, প্রয়োজন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ ও বিশ্বাস।

আজকাল বেশির ভাগ বিবাহ বিচ্ছেদের কারণগুলো যেন স্বামী-স্ত্রী নিজেদের অজান্তে তৈরি করে ফেলছে। বর্তমানে বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও মূল্যবোধের অভাব। সমস্যাটা শিক্ষিত সমাজে সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, দিন দিন বেড়েই চলেছে বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণ। বিবাহ বিচ্ছেদ আজকাল বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে বিবাহ বিচ্ছেদের ভয়ংকর ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে অগণিত পরিবার। অবশ্য মা-বাবার বিচ্ছেদের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তানরা। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলগুলোর চেয়ে শহরাঞ্চলে বিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, আজকাল নারীরা কেবল মমতাময়ী মা হয়ে বা কল্যাণময়ী গৃহিণী হয়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকতে চান না। নারীরা আজকাল সমাজের সর্বত্র বিচরণ করছেন। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি সব জায়গায়ই তারা ভূমিকা রাখছেন। বিভিন্ন কারণে হচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ।

বিশ্বাসই দাম্পত্য জীবনের মূল ‘চাবিকাঠি’। বিয়েটা যেভাবেই হোক, নিজের পছন্দ বা পারিবারিকভাবে, এমন কোনো বিষয় গোপন করা উচিত না, যেটা পরে জানতে পারলে সমস্যা হতে পারে। যদি কোনো কিছু গোপন করে থাকেন, সে জানতে পারলে ভাববে আপনি তাকে ঠকিয়েছেন। এই সমস্যা থেকেই শুরু হয়ে গেল অবিশ্বাস কিংবা অশান্তির সূত্রপাত। বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য এটা একটা বড় কারণ। একে অপরকে সম্মান করা এটি এমন একটি সম্পর্ক, যা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাকে কীভাবে সঠিকভাবে টিকিয়ে রাখা যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। ছেলে বা মেয়ে যেই হোক না কেন, বিয়ের জন্য কিন্তু উপযুক্ত একটা বয়সও বিশাল ব্যাপার। ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭’তে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর, ছেলেদের ২১ বছর পাস করা হয়েছে। বয়স কেন এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ? বয়সের ব্যাপারটা এজন্য এত গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিয়ের জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে দায়িত্ব নেওয়ার মতো মানসিকতা থাকতে হবে। লক্ষ করা যায়, ইদানীং আমরা ক্যারিয়ার নিয়ে এত বেশি ভেবে থাকি যে, আমাদেরও একটা সংসার আছে সেটা ভুলে যাই। নিজের আপন মানুষগুলোকে সময় না দিয়ে অফিসের কাজ বা মিটিং করে থাকি। ছুটির দিনটাকে পরিবারের জন্য রেখে দিলে দেখবেন কত সুন্দর একটি সময় একসঙ্গে কাটাতে পারছেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও কিছু সময় বের করুন আপনার পরিবারের জন্য। সম্পর্ক হলো একটা গাছের মতো, যাকে প্রতিদিন পানি দিয়ে যত্ন করতে হয়।

ভুল কিন্তু সবারই হতে পারে। তাই স্বামী বা স্ত্রী যদি কোনো ভুল বা অন্যায় করে থাকে, তাহলে সেটা একে-অপরকে জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। কেউ আগে ক্ষমা চাইলেই যে সে ছোট হয়ে যাবে, ব্যাপারটি তেমন নয়। দুজনই দুজনের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ ভুল করতেই পারে। ভুলটা যেই করুক না কেন, ফ্যামিলি, বন্ধুবান্ধব বা বাইরের যে

কারো সামনে না বলাই ভালো কারণ পরে স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়ে, যেটা আপনাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে থাকে। যেকোনো ধরনের সমস্যা সম্মুখীন হলে একে অপরকে সাপোর্ট করুন। সেটা হতে পারে পারিবারিক, আর্থিক,মানসিক, অফিশিয়াল ইত্যাদি। কাজের চাপ, অতিরিক্ত সময় অফিসে থাকা নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করবেন না। বরং দুজনেই একে অপরের কাজের ক্ষেত্রটা এবং সমস্যা বোঝার চেষ্টা করুন।

আর এক সঙ্গে থাকলেই যে শুধু ভালোবাসতে হবে, তেমন কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে ঝগড়া করলে ভালোবাসাও বাড়ে। ঝগড়া হতেই পারে, কিন্তু সেটা তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বড় কিছু করে ফেলা না। কিন্তু যখন ঝগড়াটা আর নিজেদের মধ্যে থাকে না, তখন হয়ে যায় বিপত্তি। কখনোই নিজেদের বিষয়টি তৃতীয় পক্ষকে জানাবেন না এমনকি বাবার বাড়িতেও না। আর্থিকভাবে অবস্থা আছে কি না বা কতটুকু সেটা, কিন্তু বিয়ের আগেই দেখে নিচ্ছেন। বিয়ে হয়ে গেলে কেন এটা দিতে পারছে না, ওটা পারছে না এভাবে বলে তাকে আর ছোট করবেন না। যৌতুকের কারণে অনেক বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে। সবারই স্বাধীনভাবে চলার অধিকার আছে, কিন্তু সেটা করারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই দ’জনের সম্মতি নিয়ে কাজ করা উচিত। স্বাধীনতা মানেই কিন্তু অশ্লীলতা নয়। বিশ্বাস করে কেউ কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে বরঞ্চ বুঝে কাজ করুন। আপনাকেও বুঝতে হবে আপনার সঙ্গে অন্য একজনের জীবন জড়িয়ে আছে।

মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় যে, বিয়ের পরেও ভেবে থাকে তারা এখনও বাবার বাসায় আছে। কিন্তু তাদের যে নতুন একটা দায়িত্ব যোগ হয়েছে, সেটা ভুলে গেলে হবে না। শ্বশুর-শাশুড়ি কিন্তু আপনার বাবা-মায়ের মতো। আবার ছেলের বউ চলে এসেছে এখন সব দায়িত্ব বউয়ের। এই চিন্তা করা ঠিক নয়, সময় দিন সবকিছুর জন্য। আবার দেখা যায়, মেয়েজামাই যখন মেয়েকে কাজে সাহায্য করে খুব ভালো লাগে। বাহ আমার মেয়ের কপাল এত ভালো একটা জামাই পেয়েছে। এই কাজটা যখন আপনার ছেলে করে, তখন আপনারাই বলে উঠেন আমার ছেলে আর আগের মতো নেই, বউয়ের গোলাম হয়ে গেছে। এখনকার অনেক মেয়েরাই চাকরিজীবী। বিয়ের পর সংসার এবং অফিস দুটাই সামলানো অনেক কঠিন। বাসায় ফিরে আবার রান্না এবং অন্যান্য কাজ থাকে। স্ত্রীকে সাহায্য করুন আপনার সাধ্যমতো। কাজ ভাগাভাগি করে নিন। দেখবেন আপনাদের মধ্যকার সম্পর্কের কতটা পরিবর্তন হয়।

প্রযুক্তিগত মিডিয়ার খারাপ দিক এর জন্য সংসারে ঝামেলা হয়। সবকিছুরই ভালো-মন্দ দিক আছে। প্রযুক্তি আমাদের যেমন সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি পেছনেও টানছে। যেমন মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা সারা বিশ্বের সব তথ্য জানতে পারি ঠিক; তেমনি এর খারাপ দিকটাও আছে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, পাশ্চাত্য দেশের সিরিয়ালের জন্য ব্যাপকভাবে সংসারে অশান্তি দেখা যায়। জীবনটা কিন্তু টিভি-সিরিয়াল না। বাস্তবতার সঙ্গে সাজানো নাটকের কোনো মিল পাওয়া যাবে না। যখনই নিজের জীবনকে টিভি সিরিয়ালের মতো ভাবতে যাবেন, তখনি কিন্তু বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস্যাপ, ভাইভার, ইমো ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়া বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য অনেক দিক থেকেই দায়ী। বাড়তি বিনোদনের জন্য অনেকেই নতুন বন্ধুর খোঁজে নিজের বিবাহিত জীবনটিকে দুর্বিষহ করে তুলছেন। অন্য পুরুষ বা মহিলার প্রতি বিয়ের পর আসক্তিকেই পরকীয়া বলা হয়ে থাকে। নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে অনেকেই এই কাজটি করে থাকেন। কিন্তু সমস্যা যদি থাকে এর সমাধানও কিন্তু আছে। অনেকের পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারে। কিন্তু আপনার সমস্যাগুলা পার্টনারকে বুঝিয়ে বলে দেখুন না, বাইরের প্রতি আসক্তি নাও হতে পারে। ভয়ংকর এই পরকীয়ার জন্য ঘটে বিবাহ বিচ্ছেদ।

আসলে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ খুঁজলে অনেক কিছুই পাওয়া যাবে। কিন্তু মাঝে মাঝে সংসারের জন্য হলেও ত্যাগ স্বীকার করুন। ডিভোর্স কথাটা খুব ছোট, কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ না। এর সঙ্গে শুধু দুজন মানুষ না, দুটা পরিবারের সবাই জড়িত। বিয়ের মাধ্যমে নতুন একটি সংসারের যাত্রা হয়। কিন্তু সংসার ভাঙনের এই প্রবণতা দিন দিন কেবলই বাড়ছে। যখন পারস্পরিক ভালোবাসা ও বিশ্বাস কমে যায়, তখন সেই সংসারের বন্ধন হালকা হয়ে যায় এবং একপর্যায়ে সংসার ভেঙে যায়।

অস্থিরতার মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত নয়। সুস্থির মনে সিদ্ধান্ত নিলেই সেই সিদ্ধান্ত হবে যথাযথ। এই ভয়াবহ বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য দুজন মানুষকে সব সময়ই একে অন্যের ইচ্ছার সম্মান করতে হবে। আর একটা কথা যেটা তাদের মনে রাখতে হবে, বিচ্ছেদ কখনই সুখকর হয় না। সুতরাং সম্পর্কগুলোর যতœ নিন। দুজন কিছুটা সচেতন ও আগ্রহী হলে বিবাহ বিচ্ছেদ আটকানো যেতে পারে। তাই সবার উচিত একটি সুখী, সুন্দর পরিবার গড়ে তোলা।

Viewed 780 times

Spread the news
Copyright © All rights reserved. | Newsphere by AF themes.
error: Content is protected !!